জুলাই আন্দোলন: হৃদয়ে বাংলাদেশ, প্রবাসেও বিপ্লবের অশ্রু

লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ানঃ জুলাই—সময়পঞ্জির পাতায় এক সাধারণ মাস হলেও ২০২৪ সালের জুলাই আমাদের কাছে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাসের নাম। আমরা তখন আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র—দেহে প্রবাসে, অথচ হৃদয়ে একান্তভাবে বাংলাদেশ। সহপাঠ, পড়ালেখা, ব্যস্ততা—সবকিছুকে ছাপিয়ে আমাদের মন পড়ে থাকত দেশের মাটিতে, দেশের খবরে, দেশের মানুষের হাহাকারে। 

ঠিক তখনই নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করে দিল স্বৈরাচার। মুহূর্তেই আমরা যেন এক অনির্বচনীয় শূন্যতায় ডুবে গেলাম। না কোনো আপডেট, না কোনো বার্তা। যেন প্রাণহীন শরীর নিয়ে বেঁচে আছি, অথচ জানি না কী ঘটছে আমাদের মাতৃভূমিতে।

শুধু একটি চিন্তা অন্তরে পাথর হয়ে চেপে বসে ছিল—আমাদের ভাইয়েরা শহীদ হচ্ছেন, রক্ত ঝরছে ঢাকার রাজপথে, আর আমরা এখানে দাঁড়িয়ে কিছুই করতে পারছি না। কান্না আটকে রাখার চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে মাঝরাতে। আমাদের বালিশ ভিজে যেত অশ্রুতে। কষ্টের কথা কাউকে বলা যেত না, কারণ ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম আমরা। 

আমরা জানি না, ঠিক কতটা ছটফট করেছিলাম ওই দিনগুলোতে। শুধু জানি, আমরা দোয়া করেছি, কুরআন তেলাওয়াত করেছি, রাতভর প্রার্থনায় হাত তুলেছি—শুধু এইটুকু করার অনুমতি ছিল বিধিনিষেধের কঠোর গণ্ডির ভেতরে থেকেও। বৈদেশিক নিয়মনীতি মেনে যতটুকু সম্ভব, আমরা সেই প্রতিবাদের অংশ হয়েছি। বুকের ভেতর আগুন নিয়ে গিয়েছি ক্লাসে, ফিরেছি হোস্টেলে—চোখেমুখে ছিল শোক আর ক্ষোভের ছায়া। 

তারপর... হ্যাঁ, তারপর ইতিহাস নিজের পথ খুঁজে নেয়। একসময় শুনি—স্বৈরাচার পালিয়েছে, জনতার জোয়ারে টিকে থাকতে পারেনি। সেই মুহূর্তটি, সেই আনন্দের নিদারুণ মুহূর্ত, আমাদের কাছে ছিল যেন এক বিকল্প একাত্তর। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, তারা দেখেছি এক নতুন মুক্তির স্বাদ—ছাত্র জনতার দৃপ্ত পদচারণা, সাহস, আর সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার জয়। ওটা শুধুই খবর ছিল না, ওটা ছিল জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। 

আমরা উদযাপন করেছি—নিজের মতো করে, সীমাবদ্ধতার মাঝেও। মিষ্টি কিনেছি, দেশের খাবার দিয়ে আয়োজন করেছি ছোটখাটো মিলনমেলা। সেখানে ছিল না কোনো ক্যামেরা, ছিল না কোনো প্রচার—ছিল কেবল ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও দেশপ্রেম। আবারও দোয়া করেছি, শহীদদের জন্য, বিজয়ের জন্য। 

এই জুলাই, এই আন্দোলন, এই হৃদয়ের তোলপাড় আমাদের স্মৃতিতে চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবে। হয়তো সরাসরি মাঠে থাকতে পারিনি, কিন্তু বুকের ভেতর যে আগুন ছিল, সেটিও ছিল একপ্রকার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে আমরা পরাজিত হইনি—বরং পেয়েছি সাহস, শক্তি আর এক নতুন স্বপ্নের দীপ্তি। 

জুলাই আমাদের চোখের জলের ইতিহাস। জুলাই আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে গর্বের গাঁথা হয়ে থাকবে—যেখানে ছাত্ররা ছিল অগ্রভাগে, আর বাংলাদেশ ছিল হৃদয়ের মণিকোঠায়। 

লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর

Post a Comment

Previous Post Next Post