বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আদিবাসী, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী প্রসঙ্গ ও জাতীয় নিরাপত্তা ভাবনা

মেজর জেনারেল (অব.) ড. মো. নাঈম আশফাক চৌধুরী
পার্বত্য চট্টগ্রাম  | ২২ আগস্ট ২০২৫(শুক্রবার)
আজ আমরা এমন একটি বিষয় নিয়ে কথা বলবো যার সাথে আমাদের প্রাণপ্রিয় এ দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভূমির অখন্ডতা জড়িত। বাংলাদেশে আদিবাসী কে? বাংলাদেশে আদিবাসীদের অস্তিত্ব আছে কিনা? এ দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কেউ কেউ নিজেদের এ অঞ্চলের আদিবাসী হিসেবে দাবি করছেন তার যৌক্তিকতা আছে কিনা?

তাদেরকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে দেশের কি অসুবিধা? জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট ফোরাম আদিবাসী ও উপজাতি হিসেবে কাদেরকে চিহ্নিত করতে চেয়েছে? আদিবাসী হিসেবে যাদের চিহ্নিত করতে চাচ্ছে তাদের কি কি অধিকার দিতে চাচ্ছে? এর সাথে বাংলাদেশের সংবিধানের কোন সাংঘর্ষিক বিষয় আছে কিনা তা পর্যালোচনা করা।

এদেশে বসবাসরত সকল বৈধ নাগরিকের সমান অধিকার যা আমাদের সংবিধানে কমপক্ষে ২৭, ২৮(১) ২৮(২) এবং ২৯(১) অনুচ্ছেদে নিশ্চিত করা হয়েছে। রাষ্ট্র হিসেবে আমরা সকল নাগরিককে, বিশেষত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিতে যথেষ্ট কাজ করছি কিনা অথবা করার সদিচ্ছা আছে কিনা তা পর্যালোচনা করা। আজকের এ আলোচনাংশে ৪ টি মূল প্রতিপাদ্য আঙ্গিক জড়িত। প্রথমত ঐতিহাসিক, দ্বিতীয়ত আইনগত, তৃতীয়ত আর্থ সামাজিক এবং চতুর্থটি নিরাপত্তা বিষয়ক।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : প্রথমে ঐতিহাসিক পর্যালোচনা। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে হাজার হাজার বছর ধরে বাংগালীদের সাথে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। বাংলাদেশে আবিষ্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায় কুমিল্লার ময়নামতিতে, খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের প্রাচীন পুন্ড নগর, মৌর্য ও গুপ্ত যুগের নিদর্শন বগুড়ার মহাস্থানগড়ে, খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের নদীভিত্তিক সভ্যতার নিদর্শন চন্দ্রদ্বীপ বা বরিশালে,

দিনাজপুরের রামপুরা ও উড়ালবাড়িতে প্রাপ্ত মৃৎপাত্র ও পাথরের সরঞ্জাম প্রাগৈতিহাসিক। নরসিংদীর উয়ারী ও বটেশ্বরে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খ্রিষ্ট্রপূর্ব ৪০০ থেকে ১০০ অবধি। এরপর আমরা পাল রাজবংশ, সেন রাজবংশ, মোঘল শাসন এবং ইংরেজ শাসনের কথা উল্লেখ করতে পারি। অর্থাৎ এ অঞ্চলে বাঙালির বসবাস প্রাগৈতিহাসিক যুগ ধরে। অপরদিকে বাংলাদেশে মোট ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও উপজাতির বসবাস। তার মধ্যে ১৩ টি উপজাতি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করছে। এ জাতি গোষ্ঠী পার্শ্ববর্তী ভারত, চীন, মিয়ানমার ও তিব্বত অঞ্চল থেকে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ অঞ্চলে অভিবাসন করে। যেমনঃ

চাকমা : মঙ্গল কুমার চাকমা, জেমস ওয়ার্ড খকশী, পল্লব চাকমা, মংসিংক্রে মারমা, হেলেনা বাবলি তালাং কর্তৃক গবেষনা ও সম্পাদিত পুস্তক “বাংলাদেশের আদিবাসী:” এথনোগ্রাফিয় গবেষণা অনুযায়ী চাকমারা মূলত ছিল বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মত্যান্তরে মিয়ানমার চম্পকনগর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছে ৫০০ বছরের কম সময় পূর্বে। আনুমানিক ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ মানচিত্র প্রণেতা লাভানহা কর্তৃক অঙ্কিত মানচিত্রে চাকমাদের কথা উল্লেখ আছে।

মারমা : বাংলাপিডিয়া মতে, মারমা শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে বার্মিজ শব্দ “ম্রানমা (Mranma)” থেকে, যার অর্থ বার্মার অধিবাসী। ১৭৮৮ সালে ‘রাখাইন সায়াদাও’ নামক বৌদ্ধ ভিক্ষু দ্বারা রচিত ‘ধন্যাবতী আয়েদওবন’ নামক কর্মী ইতিহাস গ্রন্থে মারমাদেরকে ‘ম্রানমা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা বোদাওপায়া আরাকান আক্রমণ করে

আরাকান রাজ্য বার্মার অন্তর্ভুক্ত করেন। এই দখলের ফলে মারমা জনগোষ্ঠী বাস্তুচ্যুত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করে। ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে মারমা জনগোষ্ঠীকে ‘মগ’ নামে ডাকা হতো যা ছিলো অবমাননাকর এবং জলদস্যুতার সাথে যুক্ত। ১৯৪০ এর দশকে মারমা জনগোষ্ঠী নিজেদের পরিচয় ‘মারমা’ নামে পুনঃস্থাপন করে।

ত্রিপুরা : ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মূল উৎপত্তি ও আদি নিবাস ছিল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ত্রিপুরা রাজ্যে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষি ও বসতির প্রয়োজনে ১৬শ-১৮শ শতাব্দীর মধ্যে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমন করে। তারা ককবরক ভাষা ব্যবহার করে যা তিব্বত বার্মা ভাষা পরিবারের অন্তর্গত।

কুকি জনগোষ্ঠী : কুকি জনগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য নৃগোষ্ঠীরা হলো লুসাই, বম, পাংখো, ম্রো, খ্যাং ও খুমি। ধারণা করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে সবচেয়ে প্রাচীন অভিবাসন ঘটেছে কুকি জনগোষ্ঠীর ১৫শ শতক থেকে ১৮শ শতকের মধ্যে। এদের উৎপত্তি স্থল মায়ানমারের রাখাইন ও চিন রাজ্য এবং ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম থেকে।

একই রকমভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত প্রতিটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক ও জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এরা প্রত্যেকেই এ অঞ্চলে অভিবাসী হিসেবে বসতি স্থাপন করেছে। তার প্রমান প্রখ্যাত উপজাতি গবেষক ও নৃতত্ত্ববিদ RHS Huchinson (১৯০৬), T H Lewin (১৮৬৯) অমরেন্দ্র লাল খিসা (১৯৯৬), J, Jaffa (১৯৮৯) এবং N Ahmed (১৯৫৯) প্রমুখের গবেষনাপত্র, লেখা, থিসিস এবং রিপোর্ট বিশ্লেষনে পাওয়া যায়।


আইনগত প্রেক্ষাপট : আদিবাসী ও উপজাতি শব্দ দুটোর সাথে জাতিসংঘের মূলত ২টি কনভেনশন ও ১টি ডিক্লারেশন সম্পৃক্ত। প্রথমটি ILO কনভেনশন ১০৭ যার পূর্ণ নাম Indigenous and Tribal Populations Convention, 1957। স্বাধীন দেশগুলোর উপজাতীয় ও আধা উপজাতীয় (Tribal and Semi-Tribal) জনগোষ্ঠী যারা জাতীয় সমাজে সম্পূর্ণভাবে একীভূত হয়নি, তাদের জীবনমান, কর্মপরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ভূমি অধিকার উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৫৭ সালে তা গৃহীত হয়।

এই কনভেনশনে উপজাতিয় এবং আধা উপজাতিয়দের মূল জাতীয় সমাজে একীভুত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। মোট মাত্র ২৭টি দেশ অনুসমর্থন করে এবং পরবর্তীতে ৯টি দেশ এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর নিজ সংবিধান রচনার পূর্বেই ২২ জুন ১৯৭২ সালে এই কনভেনশনটি অনুসমর্থন করে। অর্থাৎ বাংলাদেশে বসবাসরত উপজাতি জনগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টিকে রাষ্ট্র হিসেবে তখনই স্বীকৃতি দিয়েছে।

তবে উপজাতীয় বা আধা উপজাতীয় হিসেবে যাদের সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এই কনভেনশনের আর্টিকেল ১ এর অনুচ্ছেদ ১খ তে তার সাথে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতীয়দের মিল নেই। সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, উপজাতীয় বা আধা উপজাতীয় বলতে তাদেরকেই বুঝানো হয়েছে যারা ঔপনিবেশিক বা বিজয়ের সময় দেশ বা অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের বংশধর হিসেবে বিবেচিত হয় এবং , যাদের স্বতন্ত্র সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান এবং যারা ঐ অঞ্চলে ঔপনিবেশিক দ্বারা দখলের পূর্ব থেকেই অবস্থান করছিল।

এ অঞ্চলে ইংরেজ শাসনামলেরও সহস্রাধিক বছর পূর্বে বাঙালির বাস ছিল। সেই বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতীয়দের এই সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না। আজ সময় এসেছে বাংলাদেশের জাতিসংঘের ILO কনভেনশন ১০৭ থেকে বের হয়ে আসার। যাই হোক, সমালোচনার মুখে পরবর্তীতে এটিকে পুনর্বিন্যাস করে ১৯৮৯ সাথে গৃহীত হয় ILO Convention ১৬৯।

এই কনভেনশন পূর্বের কনভেনশনে উল্লেখিত উপজাতির সাথে আদিবাসীকে সন্নিবেশিত করে এবং আদিবাসী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে নিজ নিজ জাতিকে। এখানে আদিবাসীদের স্বশাসন ও ভূমি অধিকারকে মূল অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অনেক বিতর্কিত ধারা সংযোজন এর কারণে বিশ্বের মাত্র ২৪ টি দেশ এই কনভেনশনে অনুসমর্থন দিয়েছে।

এশিয়ার মধ্যে শুধুমাত্র নেপাল এই কনভেনশনে অনুসমর্থন করেছে। যেহেতু বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই তাই বাংলাদেশ এই কনভেনশন সমর্থন করেনি। এরপর ২০০৭ এ জাতিসংঘের আদিবাসী জনগনের অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণা (UNDRIP)-২০০৭ গৃহীত হয়। এটি এক্সক্লুসিভলি আদিবাসীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট, উপজাতিয়দের নয়। যেহেতু বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই তাই বাংলাদেশ এই প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকে।

এখানে আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেয়া হয়েছে। এমনকি এই চুক্তির অধিকারে আদিবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় জাতিসংঘ তার সদস্য ভুক্ত দেশে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারবে। অনেক বিতর্কিত বিষয় যেমন জাতীয় সার্বভৌমত্ব, ভুমি সংক্রান্ত আইন এবং অভ্যন্তরীন আইনি কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো এতে সন্নিবেশিত হওয়াতে যে সকল দেশে আদিবাসী বিদ্যমান তারাও এর বিরোধিতা করে। এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও কানাডা উল্লেখযোগ্য।

এই ঘোষণা জাতিসংঘে গৃহীত হওয়ার পর পরই বাংলাদেশের কিছু স্বার্থান্বেষী মহল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ছদ্মাবরনে রাজনৈতিক (কমপক্ষে স্বায়ত্বশাসন) উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য দেশের বিপরীতে চক্রান্ত শুরু করে এবং জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরামে (UNPFII) এদেশের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দাখিল করে। বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ কর্তৃক সংজ্ঞায়িত আদিবাসী বিষয়ে ২০০৫, ২০১০, ২০১১, ২০১৮ এবং ২০২২ সালে বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই বলে দৃঢ় ও স্পষ্টভাবে অবস্থান ব্যাখ্যা করে।

CHT Regulation 1900 এর ৫২ নং ধারায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতিদের অভিবাসী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে, শান্তি চুক্তিতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ আইনে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনে উপজাতি হিসেবে লিপিবদ্ধ আছে। এমনকি ২০০৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কে জানানো হয় যে বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই। ঐ সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের স্পেশাল এসিসটেন্স হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন ব্যারিস্টার দেবাশিষ রায়।

১৯৯২ সালের ২৭ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ির দুদকছড়ায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সন্তুলারমা ঘোষণা দিয়েছিলেন, “আমরা উপজাতি নয় আমরা ক্ষুদ্র জাতি।” ১৯৭২ সালে তাঁরই অনুজ মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা মহান সংসদে বলেছিলেন,“আমি বাঙালি নই, আমি চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রামের একজন উপজাতি”। ২০১১ সালে বান্দরবনের বোমাং রাজা অং শ প্রু চ্যানেল আইতে ইন্টারভিউতে স্পষ্টতই বলেছেন, “আমরা আদিবাসী নই, উপজাতিতো নইই” ভারতীয় সংবিধানে কোন জনগোষ্ঠিকে সরকারিভাবে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। তাদেরকে দুই ভাগে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

একটি হলো শিডিউল কাস্ট, এবং অন্যটি শিডিউল ট্রাইব। ভারতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ বহু উপজাতীয়দের বাস। তারাও কখনো নিজেদের আদিবাসী হিসেবে দাবী করেনি। একই চাকমা অরুনাচল প্রদেশে নিজেদের শিডিউল ট্রাইবস হিসেবে স্বীকৃতি চায় যা অরুনাচলবাসীরা স্বীকার করেনা।

আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট : বাংলাদেশের সংবিধানের কয়েকটি ধারায় সকল নাগরিককে সম অধিকার নিশ্চিত করতে বলা আছে। সংবিধানের ২৩ ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ” রাষ্ট্র উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার সংরক্ষণ, বিকাশ ও প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।” যা পঞ্চদশ সংশোধনের মাধ্যমে ২০১১ সালে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত প্রতিটি নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদের সুষম আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা। এ কাজটি আমরা রাষ্ট্র হিসেবে নিশ্চিত করতে পারিনি। যার কারণে বাঙালি সহ ১৪ টি জনগোষ্ঠীর সমভাবে উন্নয়ন হয়নি। চাকমাদের মধ্যে শিক্ষিতের হার যেখানে ৭৬% সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিদের শিক্ষিতের হার মাত্র ২৩% এবং উপজাতীয়দের গড় শিক্ষার হার ৪৪%। অর্থাৎ সুষম উন্নয়ন সকল উপজাতীয়দের মধ্যে হয়নি, বাঙালি তো অবশ্যই।

মানবেন্দ্র নারায়নের স্মরন সংকলনে বর্নিত আছে, উপজাতীয়রা ১৯০০ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২টি শ্রেনীতে বিভক্ত ছিল। উচ্চবিত্ত-রাজার পরিবারবর্গ ও কর্মচারী এবং নিম্নবিত্ত। ১৯৭১ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় মধ্যবিত্ত উত্থানকাল যখন উপজাতীয়রা সরকারী বেসরকারী চাকরীতে প্রবেশ করে। ১৯৯৭ থেকে বর্তমানকালকে বলা হচ্ছে মধ্যবিত্তের চূড়ান্ত বিকাশ কাল। অর্থাৎ স্বাধীনতার পর থেকে উপজাতীয়দের যে আর্থ সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে তা এই গ্রন্থেও স্বীকার করা হয়েছে।

তবে এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সকল উপজাতিদের মধ্যে সমভাবে হয়নি বলে কুকি-চিনের বিদ্রোহ হতে দেখেছি। যে সকল আন্তর্জাতিক এনজিও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন প্রজেক্ট গ্রহণ করেন সেখানেও বৈষম্যের অভিযোগ রয়েছে। উপজাতীয়দের স্কলারশিপে যাদেরকে বিদেশে পাঠানো হয় সেখানেও বৈষম্যের অভিযোগ রয়েছে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে স্বাধীনতার পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাস্তা, ঘাট, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, পর্যটন কেন্দ্র, আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি প্রবর্তন সহ বিপুল আর্থ সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও পাহাড়ে আজ অস্ত্রের ঝনঝনাানি শোনা যায়।

নিরাপত্তা প্রেক্ষাপট : ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের গুরুত্ব অপরিসীম। IPS এবং BRI এর চলমান দ্বন্দের প্রভাব এ অঞ্চলেও আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এখানকার এবং ভারত ও মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী একই হওয়ায় আন্তদেশীয় অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মাদক চোরাচালান একটা স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিছু কিছু জনগোষ্ঠী ভারতের মনিপুরের ও মিজোরামের সশস্ত্র গোষ্ঠির সাথে সম্পৃক্ত বলে জানা যায়।

ভারত কর্তৃক শান্তি বাহিনীর আশ্রয়, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও লজিস্টিক প্রদান প্রমাণিত সত্য। এখনো জেএসএস ও ইউপিডিএফ এর অস্ত্র আমদানি ও আশ্রয় এর প্রধান স্থল ভারত। শান্তি চুক্তির পূর্বে যেখানে একটি পাহাড়ি সন্ত্রাসী দল ছিল, আজ সেখানে ছয়টি দল পাহাড়ে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। শান্তি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী নিরাপত্তাবাহিনীর ২৪১ টি ক্যাম্প গুটিয়ে নিয়েছে। ফলে একটি নিরাপত্তা শুন্যতার সৃষ্টি হয়।

এই সুযোগে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল সমূহের সন্ত্রাসী দল গুলোর আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, অপহরণ, গুলিবিনিময় ইত্যাদি দিন দিন বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ১৪৪ কিলোমিটারে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা/কাঁটাতারের বেড়া নেই। তাছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারতের সাথে ৪৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ১৩৫ কিলোমিটারে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা/কাঁটাতারের বেড়া নেই।

যার দরুন পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনসমূহ অত্যন্ত সহজে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মাদক চোরাচালানের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। মিয়ানমারের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল। সেখানে তাতমাদাও এর ফেলে যাওয়া অরক্ষিত অগণিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ আরাকান আর্মির হাতে। আরাকান আর্মি থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সশস্ত্র দল গুলো অস্ত্র চোরাচালানির সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেয়া যাবে না।

কিছু কিছু উপজাতি মিয়ানমারের Chin National Front এবং আরাকান আর্মির সাথে যুদ্ধের প্রশিক্ষন নিয়েছে এবং রাখাইনে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে বলে জানা যায়। মিয়ানমারের নারকো টেরোরিজম এর প্রভাব পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশে পড়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিও কর্তৃক এ্যাভেন্জালাইজেশনের প্রচেষ্টা এখনও বিদ্যমান। পার্বত্য অঞ্চলে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর নির্জীবতায় আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সশস্ত্র দল পালন ও ব্যবহারের মাধ্যমে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে।

প্রতিনিয়ত হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও ভূমি দখলের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাদের করাল গ্রাস থেকে শিশু কিশোরদের পাশাপাশি মহিলারাও রক্ষা পাচ্ছে না। সম্প্রতি সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন ধরনের হুমকি ও ভয়-ভীতির বিনিময়ে জোরপূর্বক মহিলাদের বিভিন্ন মিছিল ও সমাবেশে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করছে। মিছিল ও সমাবেশে অংশগ্রহণ না করলে বিভিন্ন পরিমাণ জরিমানা করা হচ্ছে।

এমনকি একই কারণে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কিছু কিছু ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে যেতে বাধা প্রাপ্ত হচ্ছে। সম্মিলিতভাবে এর প্রতিকার করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা কোন বিচ্ছিন্নতাবাদির কার্যক্রম দেখতে চাই না। নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো সুদৃঢ় দেখতে চাই। সকল অধিবাসীর সুষম উন্নয়ন দেখতে চাই। অপার সম্ভাবনার পার্বত্য চট্টগ্রামে আরো আর্থসামাজিক উন্নয়ন দেখতে চাই। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সহ সকল ধর্মের গোত্রের নির্বিঘ্নে নিজ নিজ ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চা করার সুযোগ দেখতে চাই। রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনা (State building) এবং জাতিগোষ্ঠীর সুষম উন্নয়ন (Nation bulding) সমান্তরালভাবে অগ্রগামী হওয়া দেখতে চাই।

সকল অধিবাসীর সামাজিক ও রাজনৈতিক নিশ্চিত দেখতে চাই। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগনকে জাতীয় রাজনৈতিক দলে আরো বেশী অংশগ্রহন দেখতে চাই। আমরা সুরক্ষিত বর্ডার দেখতে চাই। জেএসএস এর প্রাক্তন সহ-সভাপতি করুণালংকার ভান্তে ওরফে মনোগীত জুম্ম এর মত পার্শ্ববর্তী দেশে বসে দেশবিরোধী কার্যক্রমের সমাপ্তি দেখতে চাই। সবাই মিলে আসুন একটা সুখময়, শান্তিময় পার্বত্য অঞ্চল গড়ে তুলি।

[নোট: রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ৯ আগস্ট ২০২৫ (শনিবার) সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আদিবাসী, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী প্রসঙ্গ ও জাতীয় নিরাপত্তা ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে পঠিত মূল প্রবন্ধ।]

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন