বন্দর ও বন্দর টার্মিনাল ইজারা দেয়া যাবে না

Daily Inqilab ইনকিলাব
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৫(বুধবার)
চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে লাভজনক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ কন্টেইনার স্থাপনা-নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ড কোম্পানির কাছে ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে অন্তর্বর্তী সরকার সরে আসেনি। বরং এনসিটিসহ কয়েকটি টার্মিনাল বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে। ইনকিলাবে প্রকাশিত খবরে এমনটাই জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, টার্মিনালগুলো ৩০ থেকে ৪৮ বছর মেয়াদে ইজারা চুক্তিতে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। টার্মিনালগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি টার্মিনাল, ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে নির্মিত পানগাঁও কন্টেইনার টার্মিনাল, চট্টগ্রাম বন্দর এলাকার লালদিয়া চর কন্টেইনার টার্মিনাল। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের চিটাগাং কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) ইজারা দেয়ারও পাঁয়তারা চলছে। সব মিলিয়ে সাতটি টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানির হাতে চলে গেলে বন্দরের হাতে থাকাবে শুধু মান্ধাতা আমলের সেই জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি)। বন্দরের স্থাপনা বা টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দেয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সকারের আছে কিনা, তা বিচার-বিবেচনার দাবি রাখে। এ দাবি সত্ত্বেও সরকার কন্টেইনার ইজারা দেয়ার জন্য এত পাগলপারা হয়ে উঠেছে কেন, সেটাই প্রশ্ন। বন্দরসংশ্লিষ্ট মহলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যবসায়ীরা কন্টেইনার টার্মিনাল ইজারা দেয়ার মোটেই পক্ষে নয়। তাদের মতো, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং অর্থ-বাণিজ্যিক স্বার্থের নিরিখে কন্টেইনার টার্মিনাল এভাবে বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া একেবারেই সমীচীন নয়। বন্দর রক্ষার জন্য ইতোমধ্যে আন্দোলন শুরু হয়েছে। দিনকে দিন আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। অথচ, সরকারের এদিকে তোয়াক্কা নেই। সরকার তার পরিকল্পনা মতে কাজ করে যাচ্ছে। গত ১২ নভেম্বর অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের কমিটির এক সভায় চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিঘীর চরে কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ এবং ৪৮ বছরের জন্য পরিচালনার দায়িত্ব ডেনমার্কের একটি কোম্পানিকে দিতে চুক্তি করার সিদ্ধান্ত হয়। উল্লেখ্য, গতকাল চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁও ইনল্যান্ড কন্টেইনার টার্মিনালটি সুইজারল্যান্ডের একটি কোম্পানির কাছে দিয়ে চালু করার কথা হয় ওই সভায়। কোন শর্ত ও ভিত্তিতে এসব চুক্তি হতে যাচ্ছে বা হচ্ছে সে সম্পর্কে দেশবাসী কিছুই জানে না। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পতিত স্বৈরাচারের মতো গোপন চুক্তির মাধ্যমে বন্দরের টার্মিনালগুলো বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, চলতি নভেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। সারাদেশে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। আপনার সরকার এসব দিকে নজর না দিয়ে শেখ হাসিনার মতো গোপনে চুক্তি করছে। বিদেশিদের সঙ্গে গোপনে চুক্তি করার জন্য আপনাকে ক্ষমতায় বসানো হয়নি। রুহুল কবির রিজভী আরো বলেছেন, এখন পরিস্থিতি এমন যে, মানুষ বাঁচতে চায়, দু’বেলা খাবারের নিশ্চয়তা চায়। আপনার সেদিকে নজর নেই। বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেই। কৃষকরা মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কেউ চাল কিনলে আলু কিনতে পারছে না। নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষককে বাঁচিয়ে জনবান্ধব সরকারের পরিচয় দেন। বাম গণতান্ত্রিক জোট বন্দর ও টার্মিনাল বিদেশিদের কাছে ইজারা দেয়ার তীব্র সমালোচনা করেছে। জোটের নেতারা বলেছেন, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার বদলে কথিত চুক্তির মাধ্যমে তা ধ্বংসের পাঁয়তারা চলছে। বিগত সরকারের মতো গোপন চুক্তির মাধ্যমে দেশের বন্দর ও টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে।

অভিযোগ গুরুতর বললেও কম বলা হয়। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্ট হয় কিংবা দেশ-জনতার স্বার্থ বিনষ্ট হয়, এমন কিছু করার অধিকার কোনো সরকারেরই থাকতে পারে না। বিশেষ পরিস্থিতিতে, বিশেষ দায়িত্ব পালন এবং সরকারের স্বাভাবিক কাজ কর্ম পরিচালনা এ সরকারের কর্তব্য। এর বাইরে গিয়ে কোনো কিছু করা, সিদ্ধান্ত নেয়া, বিশেষত জাতীয় স্বার্থবিরোধী কোনো পদক্ষেপ নেয়ার অধিকার সরকারের কাছে প্রত্যাশিত নয়। রুহুল কবির রিজভী তার বক্তব্যে দেশের কৃষক ও নিম্ন আয়ের মানুষ দুর্বিষহ অবস্থার কথা কিছুটা উল্লেখ করেছেন। তিনি আংশিক বলেছেন, প্রকৃত পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। কৃষকের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। তারা ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আলু নিয়ে এবার মহাবিপাকে পড়েছে আলুচাষিরা, দাম না পাওয়ায় তাদের কয়েক হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। পেঁয়াজ উৎপাদন করেও সংরক্ষণসুবিধার অভাবে মওসুমের শুরুতে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি দেয়া এক ভাষণে কৃষকদের দূরবস্থার কথা স্মরণ করেছেন। বলেছেন, সরকার গণভোট না করে, সেই অর্থ কৃষকদের লোকসান মোচনে দিতে পারে। পেঁয়াজ সংরক্ষণে ব্যয় করতে পারে। বলাবাহুল্য, তার বক্তব্য ব্যাপকভাবে নন্দিত ও প্রশংসিত হয়েছে। প্রকৃত নেতার দৃষ্টি জনগণের সমস্যা ও কীভাবে তার সমাধান হবে, সেই দিকে নিবদ্ধ থাকে। এ প্রসঙ্গে নিউইয়র্কের সদ্য নির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানীর কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি নিউইয়র্কের সাধারণ কর্মজীবী মানুষের সমস্যাগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিয়ে তা সমাধানের পরিকল্পনা তুলে ধরেন। তাদের স্বল্প দামে বাসস্থান, কম খরচে চিকিৎসা, কর্মের ন্যায্য মজুরি, নিরাপত্তা, সমতা ইত্যাদির নিশ্চয়তার ওপর জোর দেন। তার এই বক্তব্য ও প্রতিশ্রুতির ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে নিউইয়র্কবাসী তাকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছে। তিনি মুসলিম, অভিবাসীÑ এসব তারা বিবেচনায় নেয়নি। লন্ডনের মেয়র সাদেক খানের ক্ষেত্রেও একথা সমান প্রযোজ্য। তিনি টানা তৃতীয়বার লন্ডনের মেয়র হয়েছেন

গণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি, নীতি ও কাজ যে কোনো সরকারের জনপ্রিয়তার প্রধান অবলম্বন। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচিত না হলেও গণসমর্থিত সরকার হিসেবে পরিগণিত। তার কাছ থেকে জাতীয় স্বার্থ ও জনগণের কল্যাণ ও মঙ্গলের পরিপন্থী কিছু কেউ আশা করে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সরকার জাতীয় স্বার্থ ও জনকল্যাণ উপেক্ষা করে যাচ্ছে। বন্দর ও টার্মিনাল বিদেশিদের কাছে গোপন চুক্তির মাধ্যমে ইজারা দেয়া জাতীর স্বার্থের পক্ষে যায় না। অথচ, তাই করা হচ্ছে, তাহলে বিতাড়িত স্বৈরাচারী সরকার ও অন্তর্বর্তী সরকারে মধ্যে পার্থক্য থাকলো কোথায়? এদিকে জনগণের সমস্যার অন্ত নেই। মূল্যস্ফীতি ডবল ডিজিটের কাছাকছি। দারিদ্র্য, বেকারত্ব অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। একদিকে ক্ষুধা, অন্যদিকে জানমালের নিরাপত্তার অভাব মানুষকে দিশাহারা করে তুলেছে। যানযট ও রাস্তাঘটের অবস্থা এতোটাই খারাপ যে, যাতায়াত করারও উপায় নেই। আর্থিক-মানসিক ক্ষয়ক্ষতি অপরিমেয়। ডেঙ্গু-চিকনগুনিয়াই নয়, অন্যান্য রোগব্যাধির সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত নেই। অর্থনীতির হাল ভয়াবহতার সর্বোচ্চ মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। কলকারখানা বন্ধ হওয়া অব্যাহত আছে। উপৎপাদন-রফতানি কমেছে। বিনিয়োগ নেই। সরকারের হাতে সরকার চালানোর মতো টাকাও নেই। ঋণের সংস্থান কম। অভ্যন্তরীণ উৎস প্রায় শূন্য। বাইরের উৎস থেকেও আসছে না। অর্থ-বাণিজ্যিক অবস্থার এই পেক্ষাপটে সরকারের উচিত জনগণের অভাব-দুর্গতি মোচনে ভূমিকা রাখা। অর্থ-বাণিজ্যিক উন্নয়নের প্রতি গুরুত্ব ও জোর দেয়া। দুঃজনক হলেও বলতে হচ্ছে, সরকারের এদিকে খেয়াল নেই। সরকারের ব্যর্থতা সীমাহীন ও উদ্বেগজনক। আমারা আশা করতে চাই, জনগণের সমস্যার সমাধানে সরকার মনোযোগ দেবে। অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক পরিহার করবে। বন্দর ও বন্দর টার্মিনাল ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সরে আসবে, এটাই কাম্য।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন