নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৫(শুক্রবার)ডিপি ওয়ার্ল্ডের নাম শুনলে প্রথমে মনে হয়—আরে, এরা তো একটা বিশাল কোম্পানি, যারা বন্দরে কনটেইনারের কাজ করে। ভাবা হয়, এরা এলে হয়তো আমাদের বন্দরের কাজ আরও ফটাফট হবে, দেশ অনেক 'এফিশিয়েন্ট' হয়ে যাবে। কিন্তু ভাই, আসল গল্পটা মোটেও এত সাদা-মাটা নয়! এই পুরো ব্যাপারটা একটা গভীর আর অন্ধকারাচ্ছন্ন ষড়যন্ত্রের মতো। ধারাবাহিক আলোচনা করছি তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে।
আসুন সহজ করে বুঝি, কেন এই কোম্পানিকে আমাদের কোনো লাভজনক বন্দরের 'অপারেশনাল কন্ট্রোল' দেওয়া মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা, আর কেন আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
ডিপি ওয়ার্ল্ডের চেয়ারম্যানের গোপন বন্ধু: জেফরি এপস্টাইন!
ব্যাপারটা শুনলে মাথা ঘুরে যাবে। ডিপি ওয়ার্ল্ডের চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদ বিন সুলায়েম-এর সঙ্গে কুখ্যাত শিশু যৌ×ন অপরাধী ও মানব পাচা×রকারী জেফরি এপস্টাইনের ভীষণ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল!
বহু প্রমাণ আছে, ফাঁস হওয়া হাজার হাজার ইমেইল বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তাদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এপস্টাইন তো নিজেকে সুলায়েমের 'সবচেয়ে বড় ফ্যান' বলেও জাহির করতো।
চিন্তা করুন এপস্টাইনের সেই জঘন্য পেডোফাইল নেটওয়ার্ক, মানব পাচা×র, আর গুপ্তচর×বৃত্তির ইতিহাস তো সবার জানা। প্রেসটিভি আর রোলিং স্টোনের মতো জনপ্রিয় সংস্থা রিপোর্ট করেছে যে এপস্টাইন নাকি আফ্রিকার হর্ন অঞ্চলে ডিপি ওয়ার্ল্ডের বন্দরগুলোর সঙ্গেও যুক্ত ছিল, যেখানে অ×স্ত্র, মা×দক আর মানুষ দেদারসে চোরাচালান হয়!
ভেবে দেখুন, এমন এক 'অন্ধকার নেটওয়ার্কের' সঙ্গে যোগসাজশ থাকা একটা কোম্পানির হাতে যদি আমাদের বন্দরের চাবি তুলে দিই, তাহলে ব্যবসার আড়ালে কোন ধরনের বিদেশী গোপন অপারেশন আমাদের দেশে ঢুকে যাবে—সেটা বুঝতে কি রকেট সায়েন্স জানা লাগে?
আফ্রিকায় ডিপি ওয়ার্ল্ডের কাজ: বন্দর নয়, যেন মিলিটারি ক্যাম্প!
আফ্রিকায় ডিপি ওয়ার্ল্ডের কার্যকলাপ দেখলে চোখ কপালে উঠবে। তারা বন্দরের কাজ করার নাম করে আসলে কী করেছে?
সামরিক ঘাঁটি, তারা ইউএই-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে সোমালিল্যান্ডের বেরবেরা পোর্টের মতো বন্দরগুলোকে শুধুমাত্র কার্গো সেন্টার না রেখে সামরিক ঘাঁটি আর গোয়ে×ন্দা হাব বানিয়ে দিয়েছে। সেখান থেকে ইয়েমেন, সুদানে অ৮স্ত্র যায়, যুদ্ধাপরাধী মিলিশিয়াদের সাহায্য করা হয়!
লাভ কাদের? ডিপি ওয়ার্ল্ডের ঠিকই ২০২৪ সালে $১.৭ বিলিয়ন ডলার লাভ হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় দেশগুলোর কী হয়েছে? অস্থিরতা, লুটপাট আর রক্তপাত!
জিবুতি সরকারও তাদের আসল চরিত্র বুঝতে পেরেছিল। চোরাচালানের অভিযোগে ২০১৮ সালে ৩০ বছরের চুক্তি বাতিল করে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে! এমন কোম্পানির হাতে নিজেদের লাভজনক বন্দর তুলে দিলে, ব্যবসার আড়ালে আমাদের আম-ছালা দুটোই যাবে!
আমাদের সার্বভৌমত্ব কেন ঝুঁকিতে?
বিদেশী অপারেটর দিয়ে বন্দর চালানোর দরকারটা কী, যেখানে আমরা নিজেরাই ভালো করছি?
আমাদের বন্দরের মান: চট্টগ্রামের মতো লাভজনক বন্দরের বার্ষিক আয় প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এখানে কোনো জাহাজ জট নেই, জাহাজ আসার পর অপেক্ষার সময় প্রায় শূন্য, আর 'টার্ন-অ্যারাউন্ড টাইম' (মাল খালাস করে জাহাজ চলে যেতে লাগা সময়) মাত্র ১.৮ থেকে ২.২ দিন। (তথ্যসূত্র: World Bank LPI)।
অথচ ডিপি ওয়ার্ল্ডের চালানো ভারতে মুন্দ্রা পোর্টে সময় লাগে ২.৯ দিন! তাহলে আমরা কেন তাদের ডেকে আনব?
শ্রীলঙ্কা তাদের হাম্বানটোটা পোর্ট চীনকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিয়েছিল। এখন সেটা কার্যত নৌঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে, আর দেশটা নিজের সার্বভৌমত্ব হারিয়েছে! তুরস্কের ইজমির বন্দরেও ডিপি ওয়ার্ল্ড হঠাৎ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপারেশন বন্ধ করে দিয়ে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল।
প্রশ্ন একটাই: কোনো আন্তর্জাতিক সংঘাতে যদি তারা আমাদের বন্দর বন্ধ করে দেয়, তখন আমরা কী করব? যখন আমেরিকার মতো দেশও তাদের ৯৯% বন্দর নিজের হাতে রাখে, তখন আমরা কেন এই পাগলের মতো ঝুঁকি নেব?
লাভজনক সম্পদ বিদেশী হাতে তুলে দেওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ?
এটা ঠিক, আমাদের অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান লোকসানে আছে, দুর্নীতিতে ভরা—সেগুলো আগে ঠিক করা দরকার।
কিন্তু চট্টগ্রাম, মাতারবাড়ী, পায়রা, মংলার মতো লাভজনক, কোটি কোটি টাকার সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেওয়া মানে কী?
নিজেদের দেশের লাভজনক টাকা চলে যাবে বিদেশে।
অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থাকবে না আমাদের হাতে।
আসল সমস্যা হলো, কাস্টমসের ক্লিয়ারেন্স বা শুল্ক বিভাগের দেরির কারণেই মূলত সমস্যা হয়, টার্মিনালের কাজের জন্য নয়। তাহলে বিদেশি অপারেটর এনে কী লাভ?
স্রেফ কিছু লাভের গুজব ছড়িয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।
(তথ্যসূত্র: PressTV, Rolling Stone, The Cradle, Drop Site News, Middle East Eye, World Bank LPI 2023-24)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন