বন্দর বিদেশীদের দেয়া সিঙ্গাপুরের মডেল নয়, দেশকে আফ্রিকা বানানোর মডেল” - স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি

নিজস্ব প্রতিবেদক 
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৫(রবিবার)
চট্টগ্রামের লালদিয়ার চরকে বিদেশী অপারেটরের কাছে কনসেশন চুক্তিতে হস্তান্তর এবং নিউমুরিং টার্মিনাল লিজ–প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেছে ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’। আজ ২৩ নভেম্বর, দুপুর ৩’টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়।

সংবাদ সম্মেলনে স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’র নেতৃবৃন্দ ৭টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তুলে ধরে বলেন, দেশের অর্থনীতি ও সার্বভৌম নিরাপত্তাকে বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্র ভারত, ইজরাইল ও আমেরিকার স্বার্থে কাজ করা ডিপি ওয়ার্ল্ড ও এপিএম টার্মিনালসের কাছে বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর কনসেশন বা ইজারায় দেয়া মারাত্মক রকমের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ভবিষ্যতে এসব বিদেশী অপারেটর আমাদের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন এবং সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণে পদে পদে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে! রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্যে বন্দরগুলো ব্যবহার হতে পারে! সুদানের মত বন্দর থেকে পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদদাতা হয়ে উঠতে পারে! সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ইশারায় দেশে গৃহযুদ্ধ তৈরীর নীল-নকশা তৈরী ও ইন্ধনদাতা হয়ে উঠতে পারে! পুরো চট্টগ্রাম বিভাগের সার্বভৌমত্বকে হুমকীর মুখে ফেলে দিতে পারে! এমনকি সুযোগ বুঝে দেশের মানচিত্র পরিবর্তনেরও দু:সাহসও দেখাতে পারে! এছাড়া সামরিক-অর্থনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তি, দেশের স্পর্শকাতর তথ্য ভারত, ইজরাইল তথা বিদেশীদের কাছে পাচার করা এবং দেশের ক্রান্তিকালে চট্টগ্রাম বন্দর নামক রাষ্ট্রের টুটি চেপে ধরে বৈদেশিক আনুগত্যে বাধ্য করার মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে বিদেশী অপারেটরগুলো!

দ্বিতীয়ত:
৯০ ভাগ আমদানী-রপ্তানিরর কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে দেশের প্রতিটি নাগরিকের দৈনন্দিন জীবনের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বন্দর বিদেশীদের হাতে চলে গেলে আমদানী-রপ্তানী থেকে আসা অর্থের বড় একটা অংশ বিদেশে চলে যাবে, যেটা এতোদিন দেশের রিজার্ভে যোগ হতো। ফলে, দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং আমাদের রিজার্ভের উপর চাপ পড়বে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হবে, বেকারত্ব বাড়বে ও স্থানীয় পরিচালন দক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ট্যারিফ বাড়ানোয় নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাবে। সবশেষে, দেশীয় উদ্যোক্তা ও মালিকানা প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী বা শ্রমিকে রূপান্তর হবে এবং দেশীয় প্রতিষ্ঠান দেউলিয়াকরণের দিকে যাবে। জব তৈরীর নামে আফ্রিকার মত বিদেশীদের অনুগত এক কামলা শ্রেণীতে পরিণত হবে ভবীষ্যত প্রজন্ম। “মালিক হবে বিদেশী, কামলা হবে বাংলাদেশী”- এরকম অবস্থা দাঁড়াবে!

তৃতীয়ত:
বিদেশী অপারেটর কোম্পানীগুলোর মাধ্যমে দেশীয় বা স্থানীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের উপর একের পর এক বৈদেশিক আধিপত্য ও আঘাত আসতে থাকবে। এসব বৈদেশিকদের আগমনের কারণে চট্টগ্রাম এলাকায় ‘ন-ডরাই’ সিনেমায় কল্পিত হোটেল পতিতাবৃত্তির মত অসামাজিক কার‌্যকলাপ ব্যাপকভাবে বাড়বে। ডিপি ওয়ার্ল্ড ও এপিএম টার্মিনালস এলজিবিটিকিউ বা সমকামিতাকে সমর্থন করায় দেশে এলজিবিটিকিউ বা সমকামিতা বৈধ করতে সরকারের উপর চাপ তৈরী হতে পারে।

চতুর্থত:
চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনামের বন্দরগুলোর প্রসঙ্গ টেনে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয় অথচ সত্যটা হচ্ছে- “সিঙ্গাপুর বন্দর” এর ৩টি কন্টেইনার টার্মিনালের সবগুলো সিঙ্গাপুর নিজেই অপারেট করে। তাদের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থে সিঙ্গাপুর পোর্টের একটি কন্টেইনার টার্মিনালও বিদেশীদের হাতে দেয়া হয়নি। 
ভিয়েতনামের প্রায় ২৭০টি বন্দরের (সমুদ্র বন্দর প্রায় ৪৫টি) প্রায় সবগুলো তারা নিজেরাই অপারেট করে। শুধু ‘কাই মেপ’ সহ কয়েকটি বন্দরে ভিয়েতনামের নিজস্ব অপারেটরদের সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চারে কিছু বিদেশী অপারেটরকে সুযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এককভাবে কোনো বিদেশী অপারেটরের হাতে একটি টার্মিনালও ছেড়ে দেয়া হয়নি। অথচ বাংলাদেশে তার উল্টো চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি! 

পঞ্চমত:
দুর্নীতি ও সক্ষমতা বাড়ানোর নামে বন্দর বিদেশীদের দেয়া হাস্যকর এবং অগ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশের প্রায় সকল সেক্টরেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তাহলে শুধু বন্দরের পেছনে লাগার রহস্য কী! বন্দরে দুর্নীতি থাকলে সেটা বন্ধ করার কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশীয় পোর্ট বা অপারেটরদের সক্ষমতার ঘাটতি থাকলে দেশী-বিদেশী এক্সপার্টদের হায়ার করে এনে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এছাড়া বন্দরের কার্যক্রমকে বেগবান, লাভবান ও খরচ কমাতে বন্দর বিকেন্দ্রীকরণ তথা দেশের সবগুলো নৌ-বন্দরকে সক্রিয় ও নতুন নতুন নৌ বন্দর তৈরীর প্রজেক্ট হাতে নিতে হবে। 

ষষ্ঠত:
আইটুইউটু বা ইন্ডিয়া, ইজরাইল, আরব আমিরাত ও আমেরিকার মধ্যে হওয়া ইন্দো-আব্রাহামিক চুক্তি ও আইমেক করিডর কনসেপ্ট থাকায় বাংলাদেশের বন্দর ডিপি ওয়ার্ল্ড কিংবা এপিএম টার্মিনালসের হাতে লিজ দিলে ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, লাভবান হবে ভারত ও ইজরাইল। কারণ সব দেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও বন্দরের পার্রিপার্শ্বিকতা একরকম নয়।

সপ্তমত:
বাংলাদেশ কোনো ‘কিংডম নয়। বাংলাদেশ একটি রিপাবলিক। সেই সেন্সে বন্দরের মালিক সরকার নয়। সামষ্টিকভাবে এটি জনগণের সম্পদ। অতএব, জনগণের অভিপ্রায় ছাড়া কিংবা অস্বচ্ছ ও কোনো গোপন চুক্তি জনগণ মেনে নিবে না।
অতএব, সরকারকে আমরা স্পষ্ট বলতে চাই, চট্টগ্রাম বন্দর দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক হৃদস্পন্দন। এই সম্পদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে কোনো অস্বচ্ছ সিদ্ধান্ত জাতির ভবিষ্যৎকে ঝুঁকিতে ফেলবে নিশ্চিত। জাতীয় স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে আপসের সুযোগ নেই। অতএব, বিদেশীদের সাথে চুক্তি জনগণের নিকট খোলাসা করতে হবে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী রেজিমের মত কোনো চুক্তি/সমঝোতা গোপন করা যাবে না। একইসাথে এপিএম ও মেডলগ এসএর সাথে করা চুক্তি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে এবং ডিপি ওয়ার্ল্ডের সাথে লিজ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে।

জনগণের নিকট জবাবদিহিতা সভ্য রাষ্ট্র ও সুশাসনের পূর্বশর্ত। অতএব, যেহেতু এই মুহূর্তে সংসদ নেই, তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির উন্মুক্ত ময়দানে “বন্দর বিদেশীদের ইজারা: লাভ–ক্ষতি” শীর্ষক উন্মুক্ত আলোচনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’ আহ্বান জানাচ্ছে।  

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, ‘স্টুডেন্টস ফর সভরেন্টি’র আহ্বায়ক মুহম্মদ জিংয়াউল হক, যুগ্ম আহবায়ক মুহিউদ্দিন রাহাত, দপ্তর সদস্য জুবায়েদুল ইসলাম শিহাব, আব্দুল্লাহ আল মাহিন, জাবির বিন মাহবুবসহ আরো অনেক ঢাবি শিক্ষার্থী।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন