- পুরস্কার ঘোষণা করেও সন্ধান মিলছে না পুলিশের খোয়া যাওয়া অস্ত্রের ২৫ শতাংশ
নিহাল হাসনাইন
ছবি : বণিক বার্তা
দ্রুত গুলি চালানোর জন্য বিশ্বজুড়েই বিশেষ পরিচিতি রয়েছে সাব মেশিনগানের (এসএমজি)। প্রাণঘাতী এ স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ১০০-৩০০ রাউন্ড পর্যন্ত গুলি ছোড়া যায় মাত্র এক মিনিটে।
দ্রুত গুলি চালানোর জন্য বিশ্বজুড়েই বিশেষ পরিচিতি রয়েছে সাব মেশিনগানের (এসএমজি)। প্রাণঘাতী এ স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ১০০-৩০০ রাউন্ড পর্যন্ত গুলি ছোড়া যায় মাত্র এক মিনিটে। কার্যকর পরিসর ৫০-২০০ মিটার হওয়ায় বিশেষ পরিস্থিতিতে শহরের অপরাধ দমনে অনেক সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যায়। পাশাপাশি সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় অপরাধীদেরও পছন্দের শীর্ষে থাকে এসএমজি।
নির্বাচনের আগে এসএমজির মতো এমন প্রাণঘাতী অস্ত্রসহ রাইফেল, মর্টার শেল, পিস্তল, গুলি ও ভয়ংকর বিস্ফোরক চোরাচালানের মাধ্যমে সীমান্তপথে দেশে আসছে। এর কিছু অংশ ধরা পড়লেও বেশির ভাগই চলে যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে। অন্যদিকে আকর্ষণীয় পুরস্কার ঘোষণা করেও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের খোয়া যাওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদের মধ্যে এখনো ২৫ শতাংশ উদ্ধার হয়নি। এসব অস্ত্র নির্বাচনকালীন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সীমান্তে চোরাচালান রোধসহ সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে কাজ করে থাকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। তাদের হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে পাচারের সময় দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে মোট ১ হাজার ২২৫টি অস্ত্র, গুলি ও ম্যাগাজিন জব্দ করা হয়। এর মধ্যে গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে জব্দ হয়েছে ৯৭টি। বাকি ১ হাজার ১২৮টি গত মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ পাঁচ মাসে জব্দ করা হয়। অর্থাৎ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র চোলাচালান বাড়ছে। এ সময় জব্দ হওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে দুটি এসএমজি। এছাড়া রয়েছে তিনটি মর্টার শেল, ১১টি রিভলবার, ১৯টি পিস্তল ও পাঁচটি শটগান। প্রাণঘাতী এসব অস্ত্র ছাড়াও এ বছরের প্রথম নয় মাসে সীমান্তে মোট ১ হাজার ১০৮ রাউন্ড বিভিন্ন ধরনের গুলি জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩১ রাউন্ডই হয়েছে মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে। এছাড়া এ সময় ৩১টি ম্যাগাজিনও জব্দ হয়েছে সীমান্ত এলাকা থেকে। পাশাপাশি এ সময় দেশী পিস্তল, রাইফেলসহ অন্য আরো বেশকিছু অস্ত্র চোরাচালানের সময় সীমান্তে জব্দ হয়।
সীমান্তে জব্দ হওয়া অস্ত্রের কয়েক গুণ বেশি অস্ত্র দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক অস্ত্রের চোরাচালানে জড়িত সন্ত্রাসী ও চোরাকারবারি চক্র দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অশান্ত করতে বিভিন্ন সীমান্তে অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালান বাড়িয়েছে। তার প্রমাণ হচ্ছে, গত পাঁচ মাসে দেশে উদ্বেগজনকভাবে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার বেড়েছে। বিশেষ করে কয়েকটি চক্র দেশের পশ্চিম, দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের পাশাপাশি ছোট সীমান্ত দিয়েও নানা ধরনের অস্ত্র নিয়ে আসছে সীমান্তের ওপার থেকে। পাচার করে আনার সময় কিছু অস্ত্র বিজিবি বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে জব্দ হলেও এর কয়েক গুণ বেশি ঢুকে যাচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে। পরবর্তী সময়ে এসব অস্ত্র সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর হাতে যায়। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এসব অবৈধ অস্ত্রের জোগানও দেশে বাড়তে শুরু করেছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে এর সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী অস্ত্রের বড় চালানগুলো দেশে ঢোকে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে। এছাড়া যশোরের চৌগাছা, ঝিকরগাছা, শার্শা, দর্শনা, শাহজাদপুর, হিজলা, আন্দুলিয়া, মান্দারতলা, বেনাপোল সীমান্তের গোগা, কায়বা, শিকারপুর, দৌলতপুর, দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্র দেশে ঢুকছে। সীমান্ত এলাকার ঘাটমালিকরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ঘাট চালান। সাধারণ অস্ত্রের পাশাপাশি অত্যাধুনিক অস্ত্রও তাদের মাধ্যমে দেশে প্রবেশ করানো হয়। বিষয়টি আলোচনায় আসে ২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর। ওই হামলার জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে আমের ঝুড়িতে করে আনা হয় একে-২২ রাইফেল। যশোরের চৌগাছা সীমান্ত দিয়ে আনা হয় বোমা। আর পার্শ্ববর্তী দুই দেশ থেকে বাংলাদেশে আসা বেশির ভাগ অস্ত্র তৈরি হয় ওই দেশগুলোতেই। বিশেষ করে ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী পাটনা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বের শহর মুঙ্গেরে তৈরি হয় এসব অস্ত্র। এর আগে পাচারের সময় প্রায় অর্ধশত একে-৪৭ জব্দ করে ভারতের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মুঙ্গেরের চুরওয়া, মস্তকপুর, বরহদ, নয়াগাঁও, তৌফির দিয়ারা, শাদিপুরসহ বিভিন্ন গ্রামে অবৈধ অস্ত্র তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে।
আসন্ন নির্বাচনে এসব অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন থানা থেকে যেসব অস্ত্র লুট হয়েছে, তার ২৫ শতাংশ এখনো উদ্ধার হয়নি। পাশাপাশি সীমান্ত দিয়েও অবৈধ অস্ত্র দেশে আসছে—সেই দাবিও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করছে। একটা সমাজে যত বেশি অবৈধ অস্ত্র থাকবে, তত বেশি অপরাধের ঝুঁকি থাকবে। বিশেষ করে নির্বাচনী সংঘাত-সহিংসতা, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারে আমাদের দেশে অবৈধ অস্ত্র বেশি ব্যবহার হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘নির্বাচনে নানাভাবে আধিপত্য বিস্তার করে মাঠ দখলে রাখার প্রবণতা এক শ্রেণীর প্রার্থীদের মধ্যে দেখা যায়। আমরা দেখলাম চট্টগ্রাম-৮ আসনের গণসংযোগের সময় একজন প্রার্থী গুলিবিদ্ধ হলেন, আরেকজন মারা গেলেন। এটিই কিন্তু তার একটি বড় উদাহরণ। প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করার জন্য এ ধরনের অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হতে পারে। নির্বাচনের আগে এ ধরনের অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধে জোরালো বিশেষ অভিযান প্রয়োজন। এ অস্ত্রগুলো সীমান্ত হয়ে কীভাবে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে সে বিষয়টিও তদন্ত করে দেখতে হবে। এখানে কারো গাফিলতি থাকলে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি কোনো প্রার্থীকে অস্ত্র ব্যবহার করে ভয়-ভীতি দেখালে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই এ ধরনের অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।’
এদিকে পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময় দেশে মোট ৪৬০টি পুলিশ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল—তার মধ্যে ১১৪টি থানা (ভাংচুর ৫৮, অগ্নিসংযোগ ৫৬) এবং বিভিন্ন ধরনের ১ হাজার ২৪টি যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময় মোট ৫ হাজার ৭৫৬টি অস্ত্র লুট হয়েছে, যার মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে ৪ হাজার ৪১৩টি। এখনো বাকি আছে ১ হাজার ৩৪৩টি অস্ত্র। মোট লুট হওয়া গুলির সংখ্যা ৬ লাখ ৫২ হাজার ৮২ রাউন্ড, যার মধ্যে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৪৩৪ রাউন্ড উদ্ধার করা হয়েছে। খোয়া যাওয়া অস্ত্র উদ্ধারে এরই মধ্যে দুই দফায় আকর্ষণীয় পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে এলএমজি উদ্ধারে ৫ লাখ টাকা, এসএমজির জন্য দেড় লাখ, চাইনিজ রাইফেলের জন্য ১ লাখ, পিস্তল ও শটগান উদ্ধারে ৫০ হাজার এবং প্রতি রাউন্ড গুলির জন্য ৫০০ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়।
যদিও খোয়া যাওয়া অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান জোরদার করা হয়েছে বলে জানান পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এরই মধ্যে পুলিশের খোয়া যাওয়া অস্ত্রের মধ্যে ৭৫ শতাংশের বেশি উদ্ধার হয়েছে। বাকি অস্ত্রগুলো উদ্ধারে গোয়েন্দা কার্যক্রম এবং অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এসব অস্ত্র উদ্ধারে এরই মধ্যে আর্থিক পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে। আশা করা যায় দ্রুততম সময়ের মধ্যেই একটা ভালো ফল পাওয়া যাবে।’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন