মাহফুজ রাহমান
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৫(বুধবার)
মিয়ানমারের যুদ্ধবিধ্বস্ত রাখাইন রাজ্যের কিয়াকফিউতে চীনের নির্মিত কিয়াকফিউ ডিপ-সি পোর্ট দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনীতির নতুন কেন্দ্রবিন্দু। বন্দরটি কেন গুরুত্বপূর্ণ, তার প্রথম ব্যাখ্যাই আসে চীনের দীর্ঘদিনের কৌশলগত দুর্বলতা থেকে।
মিয়ানমারের যুদ্ধবিধ্বস্ত রাখাইন রাজ্যের কিয়াকফিউতে চীনের নির্মিত কিয়াকফিউ ডিপ-সি পোর্ট দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনীতির নতুন কেন্দ্রবিন্দু। বন্দরটি কেন গুরুত্বপূর্ণ, তার প্রথম ব্যাখ্যাই আসে চীনের দীর্ঘদিনের কৌশলগত দুর্বলতা থেকে। চীনের পূর্বাঞ্চলীয় বন্দরগুলো থেকে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা বা ইউরোপে যেতে মালাক্কা প্রণালি পেরিয়ে দক্ষিণ চীন সাগর হয়ে লম্বা পথ অতিক্রম করতে হয়। এটি শুধু ধীর নয়, ভূরাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণও। কারণ মালাক্কা প্রণালির নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর যৌথ প্রভাব বলয়ের কাছে। এ জায়গাতেই কিয়াকফিউ বন্দর চীনের জন্য বিকল্প পথ খুলে দেয়। বঙ্গোপসাগরের ওপর সরাসরি মুখ থাকা কিয়াকফিউ ডিপ-সি পোর্ট থেকে ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত চীনের স্থলভাগের পাইপলাইন ও হাইওয়ে সংযোগ তৈরি হওয়ায় বেইজিং ‘স্ট্রেইট অব মালাক্কা বাইপাস’ কৌশল পেয়েছে। এ বিকল্প রুট চীনকে মালাক্কা প্রণালি এড়িয়ে দ্রুত, নিরাপদ ও অধিক কার্যকর বাণিজ্যপথ ব্যবহার করার সুযোগ দেয়। যে কারণে বঙ্গোপসাগরে কিয়াকফিউ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টে পরিণত হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, চীনের জন্য এটি জ্বালানি নিরাপত্তার কোর নোড। মধ্যপ্রাচ্যের ক্রুড অয়েল ও গ্যাস সরাসরি কিয়াকফিউতে এসে পাইপলাইনে চড়ে ইউনান পর্যন্ত যায়—যেখানে আগে একই জ্বালানি মালাক্কা পেরিয়ে সমুদ্রপথে পৌঁছতে হতো। একই সঙ্গে এটি চীনের নৌশক্তির জন্য লজিস্টিক সুবিধা তৈরি করে, যা ভারত মহাসাগরে তাদের দীর্ঘমেয়াদি উপস্থিতিকে শক্তিশালী করে। ফলে কিয়াকফিউ শুধুই বাণিজ্যিক বন্দর নয়, এটি ভবিষ্যৎ সামরিক-লজিস্টিক নেটওয়ার্কে পরিণত হওয়ারও সব বৈশিষ্ট্য রক্ষা করছে।
কিয়াকফিউ থেকে চট্টগ্রাম সমুদ্রপথে দূরত্ব খুব বেশি নয়—প্রায় ২০০ নটিক্যাল মাইল, রুটভেদে কমবেশি। অর্থাৎ বঙ্গোপসাগরের একই উত্তর-পূর্ব করিডোরে দাঁড়ানো দুটি আঞ্চলিক পোর্ট—একটি চীনের কৌশলগত অ্যাসেট, অন্যটি বাংলাদেশের শীর্ষ বাণিজ্যদ্বার। এ ভৌগোলিক নৈকট্যই বন্দরটিকে বঙ্গোপসাগরে পোর্টভিত্তিক ভূরাজনীতির নজরে নিয়ে এসেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, চীন কিয়াকফিউ বন্দর হয়ে যে নতুন বাণিজ্যপথ তৈরি করছে, সেই করিডোরের পরবর্তী সম্ভাব্য বন্দর হিসেবে চট্টগ্রাম স্বাভাবিকভাবেই আলোচনায় থাকে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর কার্যত ভারত মহাসাগরের প্রবেশদ্বার। বঙ্গোপসাগরের অন্যতম কৌশলগত পয়েন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রাম। কিয়াকফিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে ওঠার পর থেকে এ পুরো উপকূলীয় এলাকায় নতুন করে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বেড়েছে। কিয়াকফিউর পর স্বাভাবিকভাবেই চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরেও বড় শক্তিগুলোর আগ্রহ বাড়বে, কারণ এ দুই বন্দর মিলেই মূলত বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব অংশের সামুদ্রিক রুট ও লজিস্টিক নিয়ন্ত্রণের একটি বড় অংশ নির্ধারিত হবে। ইন্দো-প্যাসিফিক প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের কৌশলগত গুরুত্ব তাই এখন অনেক বেশি।’ চট্টগ্রাম বন্দর বড় শক্তিগুলোর মনোযোগের কেন্দ্রে থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বন্দরকে ঘিরে আমরা যাই করি না কেন বড় শক্তিগুলো নজর রাখবে। এটা বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগর ঘিরে আঞ্চলিক ভূরাজনীতির অংশ।’
চট্টগ্রাম বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যস্ত বন্দর। দেশের মোট আমদানি-রফতানির প্রায় ৯০ শতাংশ এ বন্দরের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এটি ডিপ-সি পোর্ট নয়। এখানকার নাব্য সীমিত, বড় মাদার ভেসেল সরাসরি ভেড়ানো যায় না। ট্রান্সশিপমেন্ট করতে হয় কলম্বো, সিঙ্গাপুরের গভীর সমুদ্রবন্দরে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দর নিকট ভবিষ্যতেও সিঙ্গাপুর বা কলম্বোর মতো আন্তর্জাতিক ‘হাব-অ্যান্ড-স্পোক’ সিস্টেমের কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা কম। এ সীমাবদ্ধতা বিনিয়োগকারীদের বড় আকারের পরিকল্পনায় আগ্রহ কমিয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু ভৌগোলিক কারণে এর কৌশলগত গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়, বরং ভূরাজনৈতিক নানা প্রেক্ষাপটে বেড়েই চলছে।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কৌশলগত কারণে পোর্টভিত্তিক ভূরাজনীতির প্রভাব যে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর পড়ছে, সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। শুধু চট্টগ্রাম নয়, মাতারবাড়ীও একই কৌশলগত ভূরাজনীতির অংশ। জাপানিরা যখন মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প হাতে নেয়, তখন খুব স্পষ্টভাবে বলেছিল—এ বন্দর ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ অঞ্চল, মিয়ানমার ও আশপাশের দেশের জন্য একটি আঞ্চলিক হাব হিসেবে কাজ করবে। এ ঘোষণার পরই চীন নড়েচড়ে বসেছিল। তারা এরই মধ্যে মিয়ানমারের কোকো দ্বীপে একটি স্থায়ী নৌঘাঁটি স্থাপন করেছে। যেটা নিয়ে ভারত দীর্ঘদিন ধরেই স্পষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করছে। চীন পশ্চিম মিয়ানমারের দিকেও নতুন করে মনোযোগ দিয়েছে—যে কাজটা তারা আসলে সোনাদিয়ায় করতে চেয়েছিল, কিন্তু কৌশলগত চাপের মুখে বাংলাদেশে শেষ পর্যন্ত সেই প্রকল্প আর এগোয়নি।’
তার মতে, কিয়াকফিউ বন্দর ও করিডোরের মাধ্যমে চীন বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগরে প্রবেশের একটি তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত রুট পেয়ে গেছে। এক অর্থে বলা যায়, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে পৌঁছার ক্ষেত্রেও তাদের জন্য নতুন একটি সুবিধাজনক জানালা খুলে গেছে। এসব বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে স্পষ্ট হয়, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য পরাশক্তিগুলোও চট্টগ্রাম ও মাতারবাড়ী বন্দরে কৌশলগতভাবে আরো গুরুত্ব দিয়ে দেখবে।
বঙ্গোপসাগরে চীনের উপস্থিতির বড় অংশ দুটি কৌশলগত বন্দরের ওপর দাঁড়ানো। মিয়ানমারের কিয়াকফিউ ডিপ-সি পোর্ট এবং শ্রীলংকার হাম্বানটোটা। কিয়াকফিউ চীনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি মালাক্কা প্রণালি এড়িয়ে দ্রুত ও নিরাপদ জ্বালানি ও বাণিজ্যপথ দেয়। অন্যদিকে হাম্বানটোটা ৯৯ বছরের লিজে চীনা নিয়ন্ত্রণে, যা ভারত মহাসাগরে তাদের স্থায়ী লজিস্টিক সুবিধা তৈরি করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, মূলত ভারত মহাসাগর অঞ্চলজুড়ে চীনের বন্দর বিনিয়োগ একটি বিস্তৃত সামুদ্রিক কৌশলের অংশ। যা আফ্রিকার শিং থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়া হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। হাম্বানটোটা-কিয়াকফিউ ছাড়াও গওয়াদর, জিবুতি, দার এস সালাম, মোমবাসা, লামু, করাচি ও মালাক্কার মতো পোর্টে চীনের অবকাঠামো বা বাণিজ্যিক অপারেশন উপস্থিতি রয়েছে। এ নেটওয়ার্ক বেইজিংকে শুধু বাণিজ্যিক সুবিধাই দেয় না, বরং ভারত মহাসাগরে দীর্ঘমেয়াদি লজিস্টিক ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতাও তৈরি করে। অর্থাৎ পুরো ভারত মহাসাগরের চারপাশে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া,–দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে ১৫টির বেশি বন্দর-সংযোগের মাধ্যমে ধারাবাহিক সামুদ্রিক নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে চীন। যাকে ‘স্ট্রিং অব পার্লস ২.০’ বলে অভিহিত করেন বিশ্লেষকরা।
বিপরীতে ভারত মহাসাগরে নয়াদিল্লির উপস্থিতি তুলনামূলক সীমিত। চাবাহার, সিত্তে, দুবাই ও–দুকমসহ অন্তত চারটি বন্দর ভারতের লজিস্টিক বা উন্নয়ন নেটওয়ার্কে রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত চাবাহার বন্দরটি ইরানে; যেখানে ভারত অপারেশন, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার নির্দিষ্ট অংশে আনুষ্ঠানিক অধিকার পেয়েছে এবং আফগানিস্তান–মধ্য এশিয়া রুটে একটি বিকল্প করিডোর কার্যত নিয়ন্ত্রণ করছে। মিয়ানমারের সিত্তে বন্দর ভারত নির্মাণ করেছে ‘কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট’-এর অংশ হিসেবে। আরাকান উপকূলে ভারতের জন্য এটি কৌশলগত প্রবেশদ্বার। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই–জেবেল আলি বন্দরে ভারতীয় রফতানি, আমদানি ও ট্রান্সশিপমেন্ট প্রবাহের ওপর বড় ধরনের নির্ভরতা রয়েছে; আবার ওমানের দুকম বন্দরে ভারত দীর্ঘমেয়াদি সামরিক-লজিস্টিক প্রবেশাধিকার পেয়েছে, যা আরব সাগর থেকে গভীর সমুদ্রপথে তার নৌবাহিনীর চলাচল সহজ করে। এছাড়া জাপানের চারটি বড় পোর্ট প্রকল্প রয়েছে ভারত মহসাগর অঞ্চলে। যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি বন্দর পরিচালনায় যায় না, তবে দিয়েগো গার্সিয়া, জিবুতি ও বাহরাইনের মতো চারটি কৌশলগত নৌঘাঁটির মাধ্যমে প্রভাব ধরে রাখে। ফ্রান্সেরও রিইউনিয়ন ও মায়োটে মিলিয়ে তিনটি সামরিক পয়েন্ট রয়েছে। সব মিলিয়ে চীনই একমাত্র দেশ, যার নেটওয়ার্ক ভারত মহাসাগরজুড়ে বন্দরকেন্দ্রিক ও অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত।
চীনের বন্দর নেটওয়ার্ক এখন ভারত মহাসাগরে এমন এক ছায়া ফেলেছে যে অন্য শক্তিগুলোকে বাধ্য হয়ে পাল্টা কৌশল সাজাতে হচ্ছে। আর সেই পাল্টা কৌশলের সবচেয়ে সংগঠিত রূপটিই হচ্ছে কোয়াড। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার চার দেশের নিরাপত্তা ও কৌশলগত জোট এটি। চীনের বন্দর আধিপত্যকে সরাসরি সামরিক প্রতিযোগিতায় ঠেকানো তাদের উদ্দেশ্য নয়; বরং তারা বাণিজ্য, অবকাঠামো, সাপ্লাই চেইন ও স্বচ্ছতা—এ চারটি জায়গায় নিজেদের বিকল্প শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।
ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে কোয়াডের কৌশল এখন স্পষ্ট। প্রথমত, তারা ‘বন্দর উন্নয়নকে নিরাপত্তা কাঠামো’ হিসেবে পুনর্নির্মাণ করছে। তবে চীনের মতো লিজ নেয়ার কৌশল নেয়নি। তারা অংশীদার দেশগুলোকে উন্নত মানের ডিপ-সি পোর্ট, ট্রান্সশিপমেন্ট হাব, রেল-সমুদ্র কানেক্টিভিটি ও আধুনিক লজিস্টিক অবকাঠামো তৈরিতে সহযোগিতা দিচ্ছে। ভারতের কালাদান প্রজেক্ট বা অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র নিরাপত্তা তহবিল—সবই এ কৌশলের প্রতিফলন।
দ্বিতীয়ত, কোয়াড দেশগুলো এখন ‘সাপ্লাই চেইন রেজিলিয়েন্স ইনিশিয়েটিভ’ চালাচ্ছে, যাতে ভারত মহাসাগরের কোনো দেশ চীনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে না পড়ে। বন্দর, ফাইবার অপটিক কেবল, ইন্টারনেট গেটওয়ে, জ্বালানি অবকাঠামো—সব জায়গায় তারা স্বচ্ছতা ও মানসম্মত বিনিয়োগকে উৎসাহ দিচ্ছে। মূল লক্ষ্য হলো চীনা লোন ডিপেন্ডেন্সি বা ডুয়াল-ইউজ ফ্যাসিলিটির বিকল্প একটি নিরাপদ নেটওয়ার্ক গড়া। তৃতীয়ত, কোয়াড বর্তমানে সমুদ্র নিরাপত্তায় বড় জোর দিচ্ছে। ইন্দো-প্যাসিফিকের ছোট উপকূলীয় দেশগুলোকে স্যাটেলাইট ডেটা, ট্র্যাকিং, সমুদ্র নজরদারি এবং অবৈধ মাছ ধরা প্রতিরোধে তারা সহায়তা দিচ্ছে। এ নজরদারি চীনা রিসার্চ ভেসেল বা অজানা সামুদ্রিক কার্যক্রমের প্রভাবও সীমিত করে।
ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর ঘিরে চীনের সঙ্গে অন্য দেশগুলোর আন্তঃপ্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে না হলেও চট্টগ্রাম বন্দরকে বিশ্লেষকরা ‘সেকেন্ডারি কৌশলগত নোড’ মনে করছেন—অর্থাৎ আঞ্চলিক সমীকরণে যাকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। চট্টগ্রাম বড় জাহাজ ভেড়াতে না পারলেও অবস্থানগত কারণে এটি দক্ষিণ এশিয়ার উত্তরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিপিং পয়েন্ট। ফলে বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতায় বন্দরটির ইকনোমিক-জিওগ্রাফিক ভ্যালু রয়েছে। চীনের কিয়াকফিউ পোর্ট কার্যত একটি কৌশলগত ল্যান্ডমার্ক। বিপরীতে এর নৈকট্য চট্টগ্রাম বন্দরকে অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির দৃষ্টিতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল করে তুলেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্দর হিসেবে চট্টগ্রামের যতটা গুরুত্ব, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এর অবস্থান এবং এটাকে ঘিরে গড়ে ওঠা ভূরাজনীতির কারণে। চট্টগ্রাম বন্দর হিসেবে খুব বেশি সক্ষম নয়, এর ক্যাপাসিটি সীমিত, আর সেটাকে সিঙ্গাপুর বা কলম্বোর মতো বানানোর বাস্তব সম্ভাবনাও কম। কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এর কৌশলগত গুরুত্ব অনেক বেশি। জাপান যে ডিপ-সি পোর্টে বড় ধরনের বিনিয়োগ করছে, সেটাকে শুধু অর্থনৈতিক হিসাবে দেখলে হবে না। একটি দেশ যখন নিজ দেশের বাইরে এত বড় অবকাঠামো প্রকল্পে যায়, তখন সে শুধু রিটার্নের হিসাব করে না; বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তা, সাপ্লাই চেইন, ভবিষ্যৎ জোট রাজনীতি—এসব ভূরাজনৈতিক সমীকরণও মাথায় রাখে। এটা খুব স্বাভাবিক যে চীন হোক বা যুক্তরাষ্ট্র সবাই চাইবে বাংলাদেশ তার জোটে যুক্ত হোক। চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশীদের দেয়ারও ভূরাজনৈতিক দিক আছে বলে আমি মনে করি। এটা ঘটছে আবার অনির্বাচিত সরকারের আমলে, যেটা গণ-অভ্যুত্থানের পর পর এটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ খুব ছোট দেশ কিন্তু কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে। এ দেশকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত—সবাই নিজস্ব কৌশলগত পরিকল্পনা করবে এটিই বাস্তবতা। কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো, এই ত্রিমুখী বা দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে আমরা কী করব, আমাদের কি কোনো স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সামর্থ্য আছে? একদিকে হেলে পড়ে কোনো একটা ব্লকের অংশ হওয়ার চেয়ে বরং প্রশ্নটা হওয়া উচিত আমরা কি ভারসাম্য রেখে, কারো সঙ্গে সম্পূর্ণ একীভূত না হয়ে, সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে পারি কিনা। ভবিষ্যৎ ভূরাজনীতির বড় চ্যালেঞ্জ এখানেই।’
তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, ভূরাজনীতির চাপের কথা যতই বলা হোক, এটা বাংলাদেশের জন্য একটা বড় সুযোগও। সঠিক কূটনৈতিক নেগোসিয়েশন হলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের মতো একটি আঞ্চলিক মেরিটাইম হাব হতে পারত। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো স্পষ্ট মেরিটাইম পলিসিই গড়ে ওঠেনি। ফলে নেগোসিয়েশনের ভিত্তি তৈরি হয়নি, আর কৌশলগত সুবিধাটিও কাজে লাগানো যায়নি। নীতিনির্ধারণে দুর্বলতা ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতি এর অন্যতম কারণ।
মেরিটাইম পরামর্শদাতা ও ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া তেরেঙ্গানুর ফ্যাকাল্টি ক্যাপ্টেন ড. রেজাউল করিম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের ভেতরেও আছি, আবার মেরিটাইম সিল্ক রুটের মধ্যেও পড়ি। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার উদ্যোগে গড়ে ওঠা ব্লু ডট নেটওয়ার্কের ভৌগোলিক পরিসরেও আমরা আসি। এক দৃষ্টিতে দেখলে এসব গ্লোবাল মেগা ইনফ্রাস্ট্রাকচার কাঠামোর ভেতরে থাকা বড় সুযোগ। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা আসলে এ থেকে কোনো বাস্তব সুবিধা নিতে পারছি কিনা। আমার মনে হয়, এখানে আমাদের ডিপ্লোম্যাটিক অ্যাওয়ারনেসের ঘাটতি আছে।’
তিনি বলেন, ‘চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার জ্বালানি ও পণ্যের আমদানি-রফতানির ৬০ থেকে ৮০ শতাংশই বঙ্গোপসাগর হয়ে যায়। এজন্য তাদের দক্ষিণ চীন সাগর পেরিয়ে মালাক্কা প্রণালি দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। মালাক্কার আশপাশের দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব খুব বেশি হওয়ায় চীন এটাকে নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসেবে দেখে। সে কারণেই তারা বিকল্প রুটের চিন্তা করছে। যেমন থাইল্যান্ডে ক্রা ক্যানালের ধারণা, যদিও তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। আরেকটি বিকল্প হিসেবে তারা মিয়ানমারে কিয়াকফিউ বন্দর ও পাইপলাইন নির্মাণ করেছে। কিন্তু কোনো কারণে যদি এ করিডোর অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে, তখন তাদের আরেকটি সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে বাংলাদেশ।’
বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘রাষ্ট্র হিসেবে আমরা যদি পুরোপুরি কোনো এক পক্ষের দিকে ঝুঁকে যাই, তাহলে অন্য পক্ষ সেটাকে থ্রেট হিসেবে নেবে। কিন্তু আমরা যদি ভারসাম্য রেখে, কারো প্রভাবকে সেভাবে দৃশ্যমান না করে সবার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি, তাহলে আমাদের জন্য এটা বড় সুযোগ হয়ে দাঁড়াতে পারে।’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন